মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ২ পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 2

মনীষীদের খাওয়া দাওয়া - দ্বিতীয় পর্ব

১৩. এবার শুরু করি ঠাকুরবাড়ির রান্না আর খাবারের কথা দিয়ে



শিলাইদহে বাড়ির সবার সঙ্গে খেতে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - প্রাপ্তিস্বীকার ইন্টারনেট

এবার বলি ঠাকুরবাড়ির কথা। এ বাড়িতে সাধারণ ভাজাভুজি তো হতই, আলুভর্তা, কোর্মা, বেগুনভর্তা, মাখনমারা ঘি ছাড়াও মেটে ভাজা, শুটকিমাছ পোড়া দিয়ে জমিয়ে খিচুড়ি খেতেন রবিঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও তাঁর পরিবারের আর সকলে। সকলেই পছন্দ করতেন খিচুড়ি। এর সঙ্গে থাকত ধনেশাকের টক চাটনি। এছাড়া কখনো থাকত নানান টকমিষ্টি চাটনি। রবিঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। তিনি বলতেন, 'দই দিয়া খিচুড়ি খাইতেও মন্দ লাগে না।'

এখন ঠাকুরবাড়ির নানান ধরনের খাবারের কথা বলি, যেগুলি করতেন কবিপত্নী। ঠাকুরবাড়ির ফেলসা খিচুড়িতে থাকত মুগ বা সোনামুগ। চাল-ডাল সমান সমান। আবার কড়াইশুটি দিয়ে ফেলসা খিচুড়িতে তিনগুণ ডালের সঙ্গে একগুণ চাল। এর সঙ্গে থাকবে চালের সমপরিমাণে খোসাসমেত কড়াইশুঁটি। মুগের ডালের ফাঁপা খিচুড়িতে তিনভাগ চালে একভাগ ভাল মেশানো হয়। একইভাবে মালাই ভুনি খিচুড়িতে ডালটা থাকবে সোনামুগ। জাফরানি ভুনি খিচুড়িতে দু-ভাগ চাল, একভাগ ডাল। এবার 'খেজুরের খিচুড়ি'র কথা। দু-ভাগ চালের সঙ্গে একভাগ ডাল দিয়ে তার মধ্যে দিতে হবে প্রচুর পরিমাণে খেজুর।

ঠাকুরবাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে ভাত, পোলাও-এর সঙ্গে খিচুড়ি থাকতই। মুগডালে আদা আর মিষ্টি দেওয়া হত ঠাকুরবাড়িতে। মুগ- ডালের চচ্চড়ি, মুগডালের কারি, এ ছাড়াও মুগডাল বেটে তাতে পাতলা পাতলা করে কাটা বেগুন ডুবিয়ে বেগুনি আর তৈরি করা হত বেগুন-মুগের ফাঁপরা। প্রতিদিনের পাতে মুগডাল থাকতই। মুগডাল দিয়ে মিষ্টি বানাতে ঠাকুরবাড়ি ছিল যেন ওস্তাদ। মুগের নাড়ু, মুগের ডালের বরফি, মুগের মিঠাই ছাড়াও তৈরি হত মুগ শামলি।


আরও পড়ুন : মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

মাছের মধ্যে বিখ্যাত যশুরে রান্না কাঁচা ইলিশের ঝোল, এছাড়া চিতল মাছের পেটি ও চিতলের 'মুইঠ্যা', চালতা দিয়ে মুগের ডাল, ভাপা ইলিশ, নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি, আদার মাছ। তিনি বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের রান্নার রেসিপি আনিয়ে বাড়ির বাবুর্চিকে নিয়ে রাঁধিয়ে খেতেন, এমনই ভোজনরসিক ছিলেন কবিগুরু। ঠাকুরের প্রিয় মিষ্টি ছিল অনেকই তবে তার মধ্যে অতি প্রিয় ছিল ফুলকপির সন্দেশ, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের উপরে নারকেল কোরা ছড়ানো মিষ্টি আর লুচি তো আছেই। রবি ঠাকুরের একান্ত আপনজন মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর সব রকমের খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। অধিকাংশ সময়েই খেতেন ভাতের বদলে ভেজানো মুগ ডাল | পরবর্তী সময়ে আবার নানান ধরনের খাবার খাওয়া শুরু করেন মৃণালিনী দেবীর মায়ের আদেশ বলুন, বা অনুরোধে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) যেমন ছিলেন খাদ্যরসিক তেমন ভ্রমণপিয়াসী। তিনি একবার ঘুরতে যাওয়ার সময় সঙ্গে গরু নিয়ে যান। প্রতিদিন সেই গরুর দুধ খেতেন ১০ থেকে ১২ সের। দুধে চিনি দিতেন না। দুধের মিষ্টত্বের জন্য প্রতিদিন প্রচুর গুড় আর ঘাস খাওয়াতেন গরুকে। দেবেন্দ্রনাথ রান্না করতে খুব ভালোবাসতেন, করতেনও। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত। এই সমাজের অনেককে নিয়ে মাঝেমধ্যে যেতেন বনভোজনে।



১৪. খিচুড়ি খেতে অসম্ভব ভালোবাসতেন স্বামী বিবেকানন্দ

খিচুড়ি এমনই একটা আহার যা ভালো লাগেনি এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। চৈতন্যদেবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল খিচুড়ি। শচীমাতা নিমাইয়ের মুখ হাঁড়ি হয়েছে দেখলে তিনি বুঝতে পারতেন নদের চাঁদের জন্য রাঁধতে হবে খিঁচুড়ি। নবাব বাদশা মহাপুরুষ মনীষী—এমন কেউ নেই যার প্রিয় নয় খিচুড়ি।

পলাশীর যুদ্ধে হেরে গেলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা। তিনি যেদিন এবং যখন নৌকা করে মুর্শিদাবাদ থেকে পালাচ্ছিলেন, সেদিন তাঁর নৌকাতে রান্না হচ্ছিল খিচুড়ি।

আঠারো শতকের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত যে খিচুড়ি বেলুড় মিঠে হয় তা বিবেকানন্দের উদ্যোগ ও পরিকল্পনায়। খিচুড়ি খেতে অসম্ভব ভালোবাসতেন বিবেকানন্দ। তাঁর খিচুড়ি রান্নার রেসিপি আজও চলে আসছে বেলুড় মঠের উৎসব অনুষ্ঠানে।

তাঁর খিচুড়ি রান্নার উপকরণের মধ্যে আছে সমান মাপের চাল, মুগের ডাল আর সবজির মধ্যে আছে আলু, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, পটল থেকে কচু অবধি, কী নেই খিচুড়িতে। আর চাটনির রেসিপিতে আছে, টমেটো আমড়া কুমড়ো' দিয়ে চাটনি।


মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

শুধু যে খিচুড়ি পছন্দ করতেন, তা নয়, বিবেকানন্দের পছন্দের তালিকায় আছে মুখরোচক নানান ভাজাভুজি আর চপ। যখন বিদেশে যেতেন তখন তাঁর সঙ্গে যেত মুগ ডাল, কাঁচালংকা, পাঁচফোড়ন । বিবেকানন্দ ডালের জল খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন। তবে তার সঙ্গে একটা কাঁচালংকা অবশ্যই চাই। এমনিতেই তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন ঝাল খেতে। ভাতের সঙ্গে মোচার ঘণ্ট, ডালমাখা, মুগের মিষ্টি ছাড়াও তিনি সব রকমের মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। পরে প্রবল ডায়াবেটিসের জন্য সমস্ত মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হন। লংকাকে ফল বলা যায় না, কিন্তু এর প্রতি আশৈশব স্বামীজির প্রবল আকর্ষণ, নানা সময়ে নানা ভাবে প্রিয় লংকাকে, তিনি প্রবল সমর্থন করেছেন।

স্বামীজির সবচেয়ে প্রিয় খাবার কী জানেন? তিনিই উত্তর দিয়েছেন- আমাদের ভাত, ডাল, চচ্চড়ি, শুক্তো, মোচার ঘণ্টের জন্যে পুনর্জন্ম নেওয়াও বড়ো বেশি কথা মনে হয় না। শেষ বয়সেও তিনি শুক্তো, মোচার ঘণ্ট খেতে দিদিমার কাছে যেতেন। তাঁর আরও কয়েকটা আশ্রয় ছিল। বলতেন, 'যোগেন মা, আজ কাজ সেরে তোমার এখানে আসব, ভালো করে রাঁধবে।" রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট (১৮৯৭) স্বামী যোগানন্দকে নিউইয়র্ক থেকে চিঠি লিখেছিলেন (২৪ জানুয়ারি ১৮৯৬)— ‘যোগেনভায়া, অড়হর ডাল, মুগের ডাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমের মোরব্বা, বড়ি, মশলা সমস্ত ঠিক ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে।'


আরও পড়ুন : মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

ধীরানন্দ লিখেছেন স্বামীজির আর এক প্রিয় ফলের কথা। নেয়াপাতি ডাবের ভিতর চিনি দিয়ে সেই ডাবের খোলে বরফ ঢুকিয়ে দিয়ে খেতে তিনি ভালোবাসতেন। 'বলরামবাবুর বাড়িতে একটা ডাব নিলুম। খেয়ে ভারী খুশি। বললেন, আঃ চমৎকার, নে তুই খা । আমি খাচ্ছি, তখন বালকবৎ তিনি বলছেন, 'আমায় একটু দে না', এঁটোর জ্ঞান নেই।'

'মাছের মধ্যে কোন মাছ স্বামীজি বিশেষ পছন্দ করতেন ? অনেকের ধারণা, ইলিশ, যা দেহাবসানের দিনেও তাঁর আগ্রহে বেলুড়ে কেনা হয়েছিল। শুধু ইলিশ মাছ, তার সঙ্গে ঢাকার পুঁই ডাটার কথাও আমাদের অজানা নয়। স্বামীজির আর এক প্রিয় মাছের নাম গলদা চিংড়ি। বলরামবাবু এই প্রীতির কথা জেনেই একবার গলদার ব্যবস্থা করেছিলেন।

বিবেকানন্দ তখন নরেন। রসগোল্লার প্রতি আসক্তি ছিল অতিমাত্রায়। রসগোল্লার আকর্ষণেই তিনি প্রথম যান দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে।


১৫. কখনো পেনসিল কাটার কল শার্পনার ব্যবহার করেননি নারায়ণ দেবনাথ

হাঁদাভোঁদা , নন্টেফটে, বাঁটুল দি গ্রেট এর সৃষ্টিকর্তা নারায়ণ দেবনাথের জন্ম ১৯২৫-২০২২ । এমনিতে খুব মুখচোরা লাজুক স্বভাবের ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে সাঁতার কেটে গঙ্গা পারাপার করতেন। দু-তলা উঁচু জেটি থেকে ঝাঁপ দিতেন গঙ্গার বুকে। বিকাল হলেই বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তবে লেখাপড়া করতে চাইতেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪০-এর দশকে) 'ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ' থেকে 'ফাইন আর্টস'-এ পেইন্টিং নিয়ে আঁকার প্রশিক্ষণ নেন। যদিও তৎকালীন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ছ-বছরের কোর্সের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। মজার তথ্য — কখনো পেনসিল কাটার কল (শার্পনার) ব্যবহার করেননি। ভোজনরসিক নারায়ণবাবুর পছন্দ খাসির মাংস, চিংড়ি, ইলিশ ও কই মাছ আর মিষ্টির মধ্যে ঘিয়ে ভাজা কালোজাম। এ ছাড়াও ফিশ ফ্রাই, ফিস কবিরাজি, কাটলেট ভীষণ প্রিয়। সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন : শান্তনু ঘোষ



১৬. এই মিষ্টান্ন খেয়ে পরম তৃপ্তিলাভ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিদিনের আহার্য তালিকায় থাকত সাধারণ ভোজ্য ও পানীয়। অন্নব্যঞ্জন, খিচুড়ি, লুচি, মিষ্টান্ন, পায়েস, ফল- ফলের রস, মুড়ি, কড়াই, সুজি, বাতাসা, দুধ, খই। এই খাদ্যগুলি প্রতিদিন ঠাকুর খেতেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। ঠাকুর ছিলেন পরিমিত আহারী। মিষ্টিতে শুধু নারকেল নাড়ু আর জিলিপির উপর পক্ষপাত ছিল | ইলিশমাছের দোষটা জোনেও তিনি ছিলেন ইলিশের ভক্ত। কথাপ্রসঙ্গে একদিন তিনি বলেন, 'ডাব মাটির ত্রিশ হাত ওপরে সর্বক্ষণ রোদ যাচ্ছে, কিন্তু খেলেই শরীর ঠান্ডা। কিন্তু ইলিশ গঙ্গার দশ হাত গভীর অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়, অথচ খেয়েছ কি পেট গরম।

বরাহনগরে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের কাছে ফাল্গুর দোকান ছিল। ওই দোকানের বিখ্যাত কচুরি ঠাকুর খেয়েছেন আশ মিটিয়ে, গিরিশ ঘোষসহ তাঁর ভক্ত শিষ্যদের কাউকে খাওয়াতে বাকি রাখেননি তিনি। বহু বছর হল সেই দোকানটা আর নেই।


মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

একসময় মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত ছিল ধনিয়াখালি। খইচুর নামে একসময় খই-এর তৈরি অতি সুস্বাদু মিষ্টান্ন পাওয়া যেত এখানে। এটি তৈরি করতে মশলাই লাগত প্রায় ৫০ রকমের। এই মিষ্টান্ন খেয়ে পরম তৃপ্তিলাভ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর পছন্দের মধ্যে অতিপ্রিয় মিষ্টি ছিল কৃষ্ণনগরের সরভাজা আর গরমাগরম জিলিপি, কুলপি ও মোহনভোগ।

কামারপুকুরের অতি জনপ্রিয় মিষ্টি হল জিলিপি ও আড়াই প্যাঁচের সাদা বোঁদে। অড়হর ডাল দিয়ে তৈরি এই জিলিপি আর কোথাও পাওয়া যায় না। এখানকার বোঁদেও তৈরি হয় এই ডাল দিয়ে। সারদা দেবী ও রামকৃষ্ণদেবের ছিল অতি পছন্দের মিষ্টান্ন। জানা যায়, মুড়ি দিয়ে বোঁদে খেতে বড্ড বেশি ভালবাসতেন। বাড়িতে অতিথি এলে তিনি বোঁদে আর মুড়ি দিয়ে খেতেও দিতেন। গ্রামবাংলার মেয়ে হওয়ায় পল্লীবাংলার মাঠে-ঘাটে পাওয়া শুষনি শাক ও আমরুল শাক ছিল মায়ের অতি পছন্দের খাবার। এই বিশেষ শাক শিলে বেটে চাটনি বানিয়ে ভাতের সঙ্গে খেতে মা পছন্দ করতেন। এইসব নিজের হাতেই রান্না করতে তিনি। শেষ বয়সে এসে প্রায় প্রতিদিনই এই শাকের চাটনি খেতেন বলে জানা যায়।

নীলাচলে প্রভু জগন্নাথের প্রতি অগাধ ভক্তি-বিশ্বাস ছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের। যে কোনো দেবদেবীর ভোগের রান্না প্রসঙ্গে ভারতবরেণ্য মহাপুরুষ শ্রীশ্রীরামঠাকুরের কথা- "না খাইয়া ঠাকুরের রান্না করতে নাই, অর্থাৎ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ভোগ রান্না করা উচিত না। রান্না কইরা আস্বাদ নিইয়া যা উৎকৃষ্ট মনে হইবে তাই ঠাকুরকে দিতে হয়। সকল অবস্থায়ই ভোগ প্রস্তুত করা যায়, তাতে ভোগ অপবিত্র হয় না।"


১৭. বনফুল ছিলেন সর্বভুক

বনফুল ছিলেন সর্বভুক। সবরকমের মাছ খেতেন। তার বেশি পছন্দের ছিল রুই। নিরামিষ থেকে বেশি পছন্দের আমিষ। বেশি ভালোবাসতেন মাংস। তাঁর সুগার ছিল। ২/৩ কেজি মাংস যে কোনো সময়ে খেয়ে নিতে পারতেন। তাঁর রাঁধুনির নাম ছিল অর্জুন। একদিন ২ কেজি সিদ্ধ মাংস তিনি খেয়ে ফেলেন অর্জুনের সামনে।


১৮. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দুর্বার আকর্ষণ ছিল খিচুড়িতে

এবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা। তাঁর পছন্দের খাবারের মধ্যে আছে ভাত, মুগের ডাল, পুরি, কলা, দই আর ভাতে ভাত। তবে সবচেয়ে প্রিয় ছিল খিচুড়ি আর তেলেভাজা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। তাঁদের বাড়িতে গেলে তিনি খিচুড়ি খেতে চাইতেন। চাটনি কিংবা ভাজাভুজির প্রতি তাঁর তেমন কোনো টান বা আকর্ষণ ছিল না। তবে বেগুনি ও চপ হলে তিনি খুশি। তেলে- ভাজার মধ্যে এ-দুটিই ছিল তাঁর একান্ত প্রিয়। তবে দুর্বার আকর্ষণ ছিল খিচুড়িতে।

সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এলেন স্কটিশ চার্চে। লোকমুখে একটা কথা চলে আসছে এবং দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা আছে, তিনি 'লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের দোকান থেকে তোলেভাজা কিনে খেতেন। দোকানটি হাতিবাগানে। দেশবন্ধু যখন রবিঠাকুরের বাড়িতে যেতেন তখন সুভাষের মতো মাংস খাওয়ার আবদার করতেন। তবে সে ইচ্ছা সব সময়ই পূরণ করতেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। ইলিশ মাছ যে ছিল তাঁর অত্যন্তই প্রিয়। আমরা সকলেই জানি যে জীবনের পরবর্তী সময় এসে সমস্ত আমিশ খাদ্য ত্যাগ করেন শুধুমাত্র মাছ ছাড়া |


আরও পড়ুন : মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

সুভাষ দেশে হোক আর বিদেশেই হোক, তাঁর পছন্দের তালিকাতে থাকত ডাল ভাত পুরি আর কলা দই। রাতের খাবারে তিনি মিষ্টি পছন্দ করতেন। মুগের ডালের যে কোনো ধরনের মিষ্টি আর নাড়ুই ছিল বেশি পছন্দের। তবে সব খাওয়ার শেষে সন্দেশ, রসগোল্লা কিংবা এক পিস চমচম হলে তো আর কথাই নেই। শীতকালে পিঠেপুলি, নলেন গুড়ের পায়েস ছিল তাঁর বড়ো আদরের।


১৯. বুদ্ধদেব বসুর ভাল চায়ের প্রতি ছিল অস্বাভাবিক দুর্বলতা

বুদ্ধদেব বসুর ভাল চায়ের প্রতি ছিল অস্বাভাবিক দুর্বলতা। চা খেতে ভালোবাসতেন। দিনে বেশ ক'বার। চা পানের শৌখিনতায় তার কোনো জুড়ি ছিল কিনা আমার জানা নেই। কলমের প্রতি তাঁর ছিল দুর্মর টান। একেবারে ছেলেমানুষের মত। কেউ কলম বা বলপয়েন্ট উপহার দিলে কত যে খুশি হতেন।



২০. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খেতে ভালোবাসতেন মিঠে খিলির পান জৈত্রী ও যষ্টি মধু দিয়ে

নববধূ গৌরী খুব সুন্দর করে পান সাজতে পারতেন। তখনকার দিনে নানা ধরণে পান সাজা হোত। বিভূতিভূষণ খেতে ভালোবাসতেন মিঠে খিলির পান জৈত্রী ও যষ্টি মধু দিয়ে। সঙ্গে কখনো কখনো 'কেয়া' খয়ের মেশানো হোত পানের সঙ্গে। বিভূতিভূষণ শেয়ালদা বৈঠকখানার বাজার থেকে মিঠে পাতার পান এবং পানের মশলা কিনে নিয়ে যেতেন বাড়ী যাবার সময় । পরিণত বয়সেও তাকে শেয়ালদা বৈঠকখানা বাজার থেকে মিঠে পান এবং যষ্টিমধু ও পানের মশল্লা কিনতে দেখেছি। সেই সঙ্গে বিষ্ণুপুরী বালাখানার তামাকও কিনতে দেখেছি তাঁকে। তামাক খুব অল্প পরিমাণেই কিনতেন। দুই এক দিন ঘটা করে হুঁকোয় তামাক সাজা হোত। তাঁর ভাগ্নি উমার ঘন ঘন ডাক পড়তো বড় মামার দরবারে । উমার মত তামাক বনগাঁ বারাকপুর এবং চালকির মধ্যে কেউ নাকি সাজতে পারতো না। পরে দিদি তাঁর তামাক সেজে দিতেন। এ সব হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু আগে ও পরের ঘটনা ।



২১. সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় কাসুন্দিতে থাকে মিঠে কড়া মোলায়েম ঝাঁঝ

সৈয়দ মুজতবা আলী বহু দেশ ঘুরেছিলেন, বহু ধরনের রান্না খেয়েছেন। আরব দেশ ভ্রমণের সময় মুরগ মোসাল্লম, শিক কাবাব, শামি কাবাবের স্বাদ পেয়েছেন। জাহাজে ঘুরে বেড়াবার সময় আইরিশ ফুড আর ইতালিয়ান ম্যাকারনি খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গিয়েছিল। প্রাণ কাঁদছিল — চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য। তিনি লিখেছেন, 'মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসংগীতে কথার সঙ্গে সুরের মিলন।' নিতান্ত সন্দেশ-রসগোল্লা ছাড়া তিনি নাকি সব খাবারের সঙ্গে সরষে খাবার কথা বলেছেন। বিলিতি মাস্টার্ডের চেয়ে দেশি কাসুন্দি ছিল তাঁর প্রিয়। তার ভাষায় কাসুন্দিতে থাকে মিঠে কড়া মোলায়েম ঝাঁঝ আর বিলিতি মাস্টার্ডে বদখত মিষ্টি মিষ্টি ভাব।


২২. স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী মান্নাদের অতি প্রিয় ছিল মাছ কবিরাজি এবং কাটলেট

মান্না দে, গানের জগতে এক কিংবদন্তি, মহান ভোজনরসিক এবং বাঙালি খাবারের, বিশেষ করে মাছের প্রেমিক ছিলেন। তিনি তাঁর কলকাতা সফরের সময় তাঁর বাড়ির কাছে উত্তর কলকাতার একটি বিখ্যাত খাবারদাবার চাচাস হোটেলের খাবার নিয়মিত খেতেন । তাঁর প্রিয় ছিল মাছ কবিরাজি এবং কাটলেট। তার মেয়ে বলেন, "আমার বাবা একজন দুর্দান্ত রাঁধুনি ছিলেন এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য মাছ এবং মুরগির রান্না করতেন। তিনি একজন ভোজনরসিকও ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীনও তিনি কাটলেট ও বিরিয়ানি খাওয়ার দাবি করতেন।"


২৩. হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন লেখার ছত্রে ছত্রে এসেছে শুধু খাবারের বিবরণ

দুই বাংলার খ্যাতনামা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন লেখার ছত্রে ছত্রে এসেছে শুধু খাবারের বিবরণ। এর বাইরেও তাঁর নিজের জীবনের নানা স্তরে নানা সময়ে, কি বিপদে কি সুসময়ে—কী খেয়ে থেকেছেন, তার টুকরো বর্ণনাও বাদ যায়নি। 'হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম' গল্প সংকলনে 'মেঘ বলেছে যাবো যাবো' কাহিনীতে আলোর পথযাত্রী হিশামুদ্দিন যখন হাসিমুখে বললেন, "ক্ষিধে লেগেছে নাশতা দিতে বল। আর শোন দুধ সিরিয়েল খাব না। দুধ-চিড়া খাব। দুধ-চিড়াও না— দই-চিড়া। পানিতে ভিজিয়ে চিড়াটাকে নরম করে টক দই, সামান্য লবণ, কুচিকুচি করে আধটা কাঁচামরিচ..." কাহিনীকারের নিজস্ব এক খাবারের বর্ণনা পাওয়া যায় ।


২৪. কচ্ছপের মাংস খেতে জগদীশচন্দ্র খুব পছন্দ করতেন

বিশ্বভারতী পত্রিকায় "আমার বাল্যস্মৃতিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র" সম্পর্কে শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন --"বর্ষার পর নদীর জল নেমে গেলে বালির চরের উপর কচ্ছপ ওঠে ডিম পাড়তে। জগদীশচন্দ্র কচ্ছপের ডিম খেতে ভালোবাসতেন। আমাকে শিখিয়ে দিলেন কী করে ডিম খুঁজে বের করা যায় । শুকনো বালির উপর কচ্ছপের পায়ের দাগ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, সেই সারবাধা পদচিহ্ন এঁকেবেঁকে বহুদূর পর্যন্ত চলে। গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপ না পেলে ডিম ফোটে না; তাই কচ্ছপ নদী ছাড়িয়ে যতটা সম্ভব উঁচু ডাঙায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসে । বালি সরিয়ে গর্তের মধ্যে ডিম পেড়ে আবার বালিগুলি সমান করে চাপা দিয়ে যায় যাতে শেয়ালে সন্ধান না পায় । এত চেষ্টা সত্ত্বেও ধূর্ত শেয়ালকে সম্পূর্ণ ফাঁকি দিতে পারে না । আমাকে জগদীশচন্দ্র শিখিয়ে দিলেন কী করে পায়ের দাগ ধরে ধরে ডিমের গর্ত আবিষ্কার করতে হয়। শেয়ালের সঙ্গে আমার রেষারেষি চলতে থাকত। ডিমের খোঁজ করতে গিয়ে অনেক সময় কচ্ছপমাতারও সাক্ষাৎ মিলত। ডাঙার উপর তার পালানোর উপায় নেই, উল্টে দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া সহজ। কচ্ছপের মাংস খেতে জগদীশচন্দ্র খুব পছন্দ করতেন।"

ভগবানের একমাত্র প্রিয় খাবার এবং খেতে ভালোবাসেন মানুষের 'অহংকার'

তরুণী ষোড়শী সুধামুখী দেবী ইতিমধ্যে বামদেবের প্রিয় সব খাবার পরম শ্রদ্ধা ভক্তির সাথে তৈরী করে রেখেছেন। বামদেবের প্রিয় খাবার হ'ল পোস্তর বড়া, পোনা মাছ ভাজা (বড় পোনা মাছকে মাঝখান দিয়ে লম্বা করে কেটে দু'ভাগ করে ভাজা) মাংস (পাঁঠার মাথা সেদ্ধ করে মাংসের মত নরম করে) এবং বকাল ভোগ (ক্ষীর, ময়দা, পাটালীগুড়, বাতাসা, ও কিসমিস মিশিয়ে সিন্নির মত তৈরী করা)। সুধামুখীদেবী ইতিপূর্বে একাধিক বার এই বকাল ভোগ তৈরী করে বামদেবের সেবার জন্য পাঠিয়েছেন বামদেবের আশ্রমে। তাঁর স্বামী শচী পাণ্ডা সযত্নে তা নিয়ে গেছেন। ষোল বছরের তরুণী বধু সুধামুখী দেবী তাঁর স্বামীর কাছ থেকেই বামদেবের এই প্রিয় খাবার সব জেনে নিয়েছেন।


আরও পড়ুন : মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - গ্রন্থবিবরণী

বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নানা বই থেকে এ লেখার রসদ সংগ্রহ করা হয়েছে। কখনো হুবহু লেখা তুলে ধরা হয়েছে, কখনো করা হয়েছে ভাষার পরিবর্তন।
  • চরণ ছুঁয়ে যাই - শংকর
  • আমরা ও ফেলুদা - চিরঞ্জিত দাস
  • শারদীয়া নবকল্লোল - শিবশঙ্কর ভারতী
  • বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গ রসিকতা - অংশুমান চক্রবর্তী
  • বাঙালির রঙ্গ বঙ্গ চর্চা - চন্ডী লাহিড়ী
  • পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত দ্বিতীয় খন্ড
  • মহাপীঠ তারাপীঠ - হারাধন মুখোপাধ্যায় পৃষ্ঠা ২৫০
  • নারায়ন দেবনাথ সমগ্র পর্ব ১ - পৃষ্ঠা ৫০৪
  • হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম - হুমায়ুন আহমেদ - পৃষ্ঠা ৪৮৪
  • আচার্য জগদীশচন্দ্র আমার বাল্যস্মৃতি - শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর - বিশ্বভারতী পত্রিকা বর্ষ ১৫ পৃষ্ঠা ১০৯
  • মহাপীঠ তারাপীঠ - হারাধন মুখোপাধ্যায় - পৃষ্ঠা ২৫০
  • পিঞ্জরে বসিয়া - কল্যাণী দত্ত - পৃষ্ঠা ৬
  • মনীষীদের অসংখ্য জীবনীগ্রন্থ

আরও পড়ুন : মনীষীদের খাওয়া দাওয়া ১ম পর্ব - Bengali legends and their favorite foods part 1
>