Viswakarma Puja ranna puja - বিশ্বকর্মা পূজা ও অরন্ধন একটি লোকাচার

বিশ্বকর্মা পূজা ও অরন্ধন উৎসব: রাঢ়ের সংস্কৃতি

রান্নাপূজা/আন্নাপূজা ও অরন্ধন

রাঢ়ের সংস্কৃতিতে আন্নাপূজা রান্না পুজা। অরন্ধন পুজা । একটি লোকাচার অনুষ্ঠান। ভাদ্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত পূজা । প্রকৃতপক্ষে ভাদ্রসংক্রান্তির বিশ্বকর্মী পুজা ও অরন্ধন থকে চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজন পর্যন্ত অনুষ্ঠানের শেষ থাকে না। তারপরেই ১লা বৈশাখ বা নববর্ষের উংসব।

আন্ধন ঘর রান্নাঘর! চবিবশ পরগনার ভাষা । রন্ধন > আন্ধন হয়েছে লোকমুখে। আন্নন ঘর যে ঘরে রান্না করা হয়:

আন্না রান্না - আন্নাপূজা রান্না পুজা। অরন্ধন পুজা । একটি লোকাচার অনুষ্ঠান। ভাদ্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত পূজা । অরন্ধনের আগের রাতে ভাত ও ভাজা ব্যঞ্জন তৈরি করে রাখা হয়, অরন্ধনের দিন |

আন্নাপূজা ও অরন্ধনের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য

আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ:

  • হাওড়ায় এটি ঢেলাফেলা নামে পরিচিত।
  • বাঁকুড়ায় খইধারা।
  • বর্ধমানে খইদই।
  • নদীয়ায় পাতালফোঁড়।

অরন্ধন উৎসবের বিবরণ

অরন্ধন বিশেষ বিশেষ দিনে রন্ধনবর্জনের প্রথা । পশ্চিমবঙ্গের অনেক পরি্বারেই ভাদ্রের সংক্রান্তিতে এবং শীতলষষ্ঠীর দিনে (শ্রীপঞ্চমীর পরদিন ) রান্না করা হয় না; দশহরা এবং শ্রাবন মাসের শেষ দিনেও এই প্রথা এখনো বিভিন্ন জায়গায় পালন হয় । অরন্ধন উপলক্ষে আগের দিন রাতে রান্না করা বাসি ভাত খাওয়া হয়। শ্রাবণ সংক্রান্তির অরন্ধন অঞ্চলভেদে নানা নামে ডাকা হয়'। যেমন, হাওড়ায়.ঢেলাফেলা', বাঁকুড়ায় 'খইধারা', বর্ধমানে 'খইদই', নদীয়ার 'পাতালফোঁড়'। ভাদ্র-সংক্তান্তির অরন্ধনের অন্য নাম 'রান্নাপূজা' ৷ . শীতলষষ্ঠীর অরন্ধন ‘গোটাসিদ্ধ খাওয়া'। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় রাজনৈতিক কারণে (বঙ্গভঙ্গ ) আশ্বিনের সংক্রান্তিও অরন্ধন এবং রাখীবন্ধন দিবস রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল ।

ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে হুগলী জেলার সর্বত্র অরন্ধনের বাবস্থা আছে; অরন্ধনের অর্থ রন্ধনের অভাব। চলিত কথায় ইহাকে 'আরন্দ' বলে। অরন্ধনের আগের রাতে ভাত ও ভাজা ব্যঞ্জন তৈরি করে রাখা হয়, অরন্ধনের দিন খাওয়া হয় । অন্ন বাসী হইলে নষ্ট হয়ে যায় বলে তাহাতে জল দিয়ে পান্তাভাত করিয়া রাখতে হয়। ইলিশ মাছ ও ব্যঞ্জনের মধ্যে মসূর ডাল এবং কচুশাকই প্রধান । পরদিন আরন্দ। সে দিন উনুন জ্বলতে নেই । গৃহিণীরা উনুনের উপরে ও ভিতরে আলপনা দেন এবং ঘরে ঘরে মনসা পূজা করেন। আরন্দের দিন পরস্পর সকলেই সকলকে নিমন্ত্রণ করেন এবং সকলের বাড়তে নিমন্ত্রণ খেয়ে বেড়ায়। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে যে আরন্দ হয়, তাহার নাম 'বুড়ি আরন্দ'। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতেও আরন্দের ব্যবস্থা আছে, তাহার নাম 'ইচ্ছেরান্না' বা 'ইচ্ছারন্দ' ।

ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পূজা অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু অরন্ধনের সঙ্গে এই পূজার কোনো যোগ নাই । পক্ষান্তরে সমগ্র অনুষ্ঠানের সঙ্গে মনসা পূজার নিবিড় যোগ । অরন্ধনের পূর্বরাত্রে ভাত ও ভাজা ব্যঞ্জন প্রস্তুত হয় । এই রান্না, যা 'পান্না' নামে কথিত হয় অরন্ধনের দিন ভোজন করা হয়। উনানের ভিতর ও বাহির লেপা-মোছা ও অলংকৃত করে একটি সিজ-মনসার ডাল বসিয়ে মনসা পূজা করা হয় । অরন্ধনের দিনের উদ্বৃত্ত রান্নাকে পরের দিন বলে ‘টক-পান্না |

রান্না পুজোর ভোগ অঞ্চলভেদে আলাদা হয়?

অর্থাৎ কোথাও আমিষ ভোগ দেওয়া হয় তো কোথাও নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। আমিষ ভোগের ক্ষেত্রে ইলিশ এবং চিংড়ি মাছের রান্নার পদ দেওয়া অন্যতম। নিরামিষ ভোগের ক্ষেত্রে রকমারি ভাজা ছোলা নারকেল দিয়ে কচু শাকসহ একাধিক শাক পান্তা ভাত এবং খেসারির ডাল চালতা এবং গুড় দিয়ে চাটনি, বড়া মালপোয়া ইত্যাদি দেওয়া হয়।

অরন্ধন: বাঙালি রন্ধন প্রথার ঐতিহ্য - বিশ্বকর্মা পূজার বিশেষ খাবার

বিশ্বকর্মা পুজোর সময়কার অরন্ধন উৎসবে নিয়ম হল ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়া। এই দিন হল ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি। আর এই ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতেই মা মনসার পূজোও দেওয়া হয়। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পূজোর দিন যে অরন্ধন উৎসব পালিত হয়, তাকে অনেকে উনুন পুজো উৎসব বা গৃহ দেবতার পূজো উৎসব বলেও ডাকেন। এই দিন বাড়িতে উনুন জ্বালাবার নিয়ম নেই। তাই আগের দিন রান্না করে সেই বাসি খাবার খাওয়ার রীতি আছে অরন্ধন উৎসবে।

এই দিন রান্নাঘরের একাংশ ভালো করে পরিষ্কার করে ফণীমনসার ডাল অথবা শালুক গাছের ডাল দিয়ে মনসার ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং যত্ন সহকারে পুজো করা হয়। এই দিন বিভিন্ন রান্না মাকে ভোগে দেওয়া হয়। যদিও এই রান্নাগুলি আগের দিন রাত্রে করা হয়ে থাকে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন থাকে অমাবস্যার রাত্তির, সেই সময় গৃহস্থের বাড়িতে উনুন জ্বালিয়ে রান্না পুজোর আয়োজন করা হয়।

হুগলী জেলায় প্রথম অরন্ধনটি হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরায়; দ্বিতীয় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে - যা ঢেলাফেলা উৎসব নামে পরিচিত; তৃতীয় অরন্ধন ভাদ্র মাসে, যা এই জেলায় চচ্চড়ি পূজো নামে খ্যাত এবং সবশেষের অরন্ধন হল রান্না পূজোর অনুষ্ঠান ভাদ্র-সংক্রান্তিতে । লক্ষণীয় যে, সব অরন্ধন অনুষ্ঠানেই সিজ মনসা গাছের ডালে দেবী মনসার পুজো হয়ে থাকে।

চাষীরা যাকে বলে 'রান্না পূজো অথবা 'পান্না' ৷ 'পান্না' শব্দটি 'পান্তা"র ভিন্ন রূপ । আলু, ছাঁচি কুমড়ো, কলা, পটল, নারকেল, বেগুন, কুমড়ো, কচুর শাক, নারকেল প্রভৃতি উপাদানের নানা ভাজা ও তরিতরকারি, শোল মাছের টক, নারকেল দিয়ে কচুশাকের ঘণ্ট, তিতোপুটি ভাজা, সরলপুটির ঝাল, ময়ামাছ আর বেগুনের ঝোল, চালবাটা দিয়ে ঢেকিশাক, পিটুলি দিয়ে পাট পাতার বড়া আর তালবড়া ৷

পান্তপালা : সাধারণতঃ বছরে দুইদিন পান্তা ভাত খাবার নিয়ম। পত্রিকার ভাষায় অরন্ধন। প্রথম হল, ভাদ্র সংক্রান্তির দিন রেধে রেখে পরদিন ১লা আশ্বিন, ষষ্ঠী পুজায় ভোগ দিয়ে খাওয়া হয়। দ্বিতীয় হল, সরস্বতী পুজার দিন চৌদ্দ শাক দিয়ে নানারকম কলাই ও গোটা তরকারী (সংখ্যায় প্রতিটি ৫ অথবা ৭) সহ ব্যাঞ্জন ও ভাত রান্না করে পরদিন ষষ্ঠী-দেবীকে ভোগ দিয়ে খেতে হয়।

মূলত ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে করা অরন্ধন উৎসব হয় পিতৃপক্ষে। তারপর বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে দেবীপক্ষের জন্য। দেবীপক্ষ এলেই বাঙালিদের বাড়িতে আয়োজন শুরু হয়। বাঙালি আবার উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। তাই বলা যায় ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে অরন্ধন উৎসব হল দুর্গাপুজোর আগে বাঙালিদের করা শেষ উৎসব।

সাধারণ কচুর এক বিশেষ ভূমিকা পুজোতে

তাহলে দেখা যাচ্ছে কচু খাবার দুটো ব্রত বা পুজো বাংলায় প্রচলিত । রাধাঅষ্টমী ও রান্না পুজো । বাংলায় অনেক ধরণের কচু পাওয়া যায় । অনুমান করা হয়, কচুর উৎপত্তি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। প্রায় দু'হাজার বছর আগেও কচুর চাষ হত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। জলে আর জঙ্গলে উভয় জায়গায় কচু জন্মাতে পারে। তবে স্থলে জন্মানো কচুর সংখ্যাই বেশি। বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনাআপনি জন্মায় সেগুলোকে সাধারণত বুনো কচু বলা হয়। এর সবগুলো মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। খাবার উপযোগী জাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে মুখীকচু, জলকচু, পঞ্চমুখী কচু, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু, শোলাকচু, গাটি কচু, খারকোল ইত্যাদি। কচুর বহু আয়ুর্বেদীয় গুণাগুণ আছে বলে দাবি করা হয়। প্রজাতিভেদে কচুর মূল, শিকড় বা লতি, পাতা ও ডাটা সবই মানুষের খাদ্য।

আরও জানতে পড়ুন: বাঙালির অন্য উৎসব সম্পর্কে জানুন

“অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখ কিছু কিছু” —---- সুখের দিনে অতীতের দুঃখের দিনের কথা মনে রাখতে হয়

মুখী কচু

মুখী কচু বাংলাদেশের গুঁড়া কচু, কুড়ি কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু, ইত্যাদি নামে ও পরিচিত। মুখী কচুতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহ থাকে, রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত উপকারী। মুখী কচু একটি সুস্বাদু সবজি। এ সবজি খারিফ মৌসুমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ হয়।

ওলকচু

এতে পুষ্টি ও ঔষধি মূল্য উভয়ই বিদ্যমান এবং সাধারণত রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। বাংলাদেশে এটি গ্রীষ্ম মৌসুমে জন্মে যখন বাজারে সবজির খুব ঘাটতি থাকে। ওল কচুর রস, উচ্চরক্তচাপের রোগীকে প্রতিষেধক হিসেবে খাওয়ানো হয়।

মান কচু

মান কচুর ডগা ও পাতা বাতের রোগীকে খাওয়ানোর প্রথা এ দেশের ঘরে ঘরে প্রচলিত রয়েছে। কচু শাকে পর্যাপ্ত আঁশ থাকায় এটি দেহের হজমের কাজে সহায়তা করে।

জল কচু

সারাদেশে পানি কচু বা জল কচুর বিভিন্ন নাম রয়েছে যেমন নারিকেল কচু, জাত কচু, বাঁশকচু ইত্যাদি। সবজি হিসেবে পানি কচুর গুরুত্ব ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বাঙালি মাত্রেই এটি একটি জনপ্রিয় সবজি। কারণ এর স্বাদ এবং পুষ্টিমান ও অত্যধিক, রান্না করাও সহজ।

কচু দিয়ে রান্না

প্রজাতিভেদে কচুর মুল, শিকড় বা লতি, পাতা ও ডাটা সবই মানুষের খাদ্য। কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ অনেকেরই খাদ্য তালিকায় পছন্দের মধ্যে আছে। এছাড়াও কচুর লতি চচ্চড়ি, কচুর লতির ভুনা, কচুর লতির ইলিশ, কচুর লতির কোরমা, সরিষা বাটায় কচুর লতি আরও কত রকমের খাবার যে রান্না করা যায় তার ইয়ত্তা নেই।

(150 reviews)


‘বান’ মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্পে বিবরণ পাই —

"ভাদ্রমাসে রান্নাপূজার দিন এসেছে, এ সময়ে গৃহস্থমাত্রেই মনসাগাছ খোঁজে। রূপসী বাগদিনীর ছেলে চিনিবাস মনসাগাছ খুঁজতে গেল। মনসাগাছ নিয়ে পূর্বস্থলীর গৃহস্থরা উঠোনে পোঁতে। মনসা বাস্তু। মনসা ক্ষেতে ধান, গাইয়ের পালানে দুধ, পুকুরে মাছ, গৃহস্থ বউয়ের কোলে ছেলে দেন। কিন্তু ঘরে ঘরে মনসাগাছ থাকে না। রান্নাপূজার পরদিন অরন্ধন । শোল মাছের টক, নারকেল দিয়ে কচুশাকের ঘন্ট, তিতোপুঁটি ভাষা, সবলশুঁটির ঝাল, ময়ামাছ আর বেগুনের ঝোল, চালবাটা দিয়ে ঢেঁকিশাক, পিটুলি দিয়ে পাট পাতার বড়া আর তালবড়া। পরদিন দু'বেলা ধরে চিনিবাস তাই খেয়েছিল।"


You might be interested in The Top 13 Traditional Edible Green Dishes of Bengal

Share:

শীতল-ভোগ কোনটি

'শীতল' শব্দটি রাঢ় বাংলার । স্থানীয়ভাবে দেবদেবীর ভোগ হিসেবেও ঠাণ্ডা খাদ্য উৎসর্গ করার নাম 'শীতল-ভোগ'। দক্ষিণ ২৪ পরগণার জনপ্রিয় লোকাচার 'রান্নাপূজা” রাঢ় এর জনপ্রিয় লোকাচার অরন্ধন বা শীতল এইরকম একটি অভিপ্রায়কেই নির্দেশ করে। আগের রাত্রে রান্না করে পরের দিন খাওয়ার রীতি ।

হাওড়া জেলার এক লোকউৎসব হল মনসা পূজা এবং তাকে কেন্দ্র করে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে হয় অরন্ধন উৎসব। এ জেলায় প্রথম অরন্ধনটি হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরায়; দ্বিতীয় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে-যা ঢেলাফেলা উৎসব নামে পরিচিত; তৃতীয় অরন্ধন ভাদ্র মাসে, যা এই জেলায় “চচ্চড়ি পূজো নামে খ্যাত এবং সবশেষের অরন্ধন হল রান্না পূজোর অনুষ্ঠান ভাদ্র-সংক্রান্তিতে । লক্ষণীয় যে, সব অরন্ধন অনুষ্ঠানেই সিজ মনসা গাছের ডালে দেবী মনসার পুজো হয়ে থাকে। পূজায় এইসব ভোজ্য নিবেদন করা হয়। কয়েকটি বিশেষ ব্যঞ্জনের মধো থাকে নারিকেল কুম্ড়ি, কচুশাক ঘন্ট, নারিকেল ভাজা, সজিনাশাক ভাজা, ওলভাজা, জমাটবাধা ডাল ও ইলিশমাছ ভাজা । এই অরন্ধন উৎসব বাংলার বহু অঞ্চলে সমারোহের সঙ্গে পালন হয় ।

আরন্পালা অরন্ধন [ অন্ততঃ দুই প্রকারের শাক অরন্ধন ও ভাত অরন্ধন । ছয়-সাত রকমের শাক রাত্রে রান্না করা হয় | পরের দিন সকালে শুধু ভাত রেধে এ বাসি শাক সহযোগে খাওয়া হয় । এটি অনুষ্ঠিত হয় শ্রাবণ মাসে মনসাপূজার সময় । আর ভাদ্রমাসের যে-কোনো একদিন, মঙ্গলবার অগ্রগণ্য, ভাত অরন্ধন করা হয় ।

লোকাচার ও লোকায়ত সংস্কৃতি

ভাদ্র সংক্রান্তির অরন্ধনের দিনে উনুনের ভিতর সিজ বা মনস! গাছের ডাল রেখে সাধারণত মনসা পুজা! করার রীতি। মনসাদেবীর সাপ এদিনে বৃষ্টি ও জলের উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নানা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে-উনুনের গর্ভেও গিয়ে লূুকোয় সে। এ দিনে উনুনের লুক্কায়িত সাপেরা যাতে নিরাপদে বিশ্রাম করতে পারে তার জণ্যই অরন্ধনের সূত্রপাত বলে কিছু লোক মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে বিশ্বকর্মা পুজা উপলক্ষে সমস্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় রন্ধন সামগ্রীর ব্যবহারও লোকাচার অনুযায়ী নিষিদ্ধ । যার ফলে অরন্ধন প্রতিপালন না করে উপায় থাকে না ।

উপাচার

নতুন মাটির হাড়িতে আতপ চালের ভোগ রান্না হয় । এই হাড়িকে বলে ভোগের হাড়ি । পরদিন অরন্ধন পুজা । সকালে ভোগ-রান্নার উনোন পরিষ্কার করে মনসা গাছের ডাল এনে বসিয়ে রাখতে হবে। ভোগের হাঁড়ির গলায় পরিয়ে দিতে হবে খাল-পুকুর থেকে তুলে আনা শাপলার মালা। এরপর শাপলার পাতায় নিবেদিত হবে অষ্ট নাগের উদ্দেশে ভোগনৈবেদ্য। ভোগের হাঁড়ি থেকে আতপচালের পান্তার সঙ্গে রান্না করা সব আমিষ ও নিরামিষের পদ আটটা শাপলা পাতায় সাজিয়ে অষ্টনাগকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। ফলমূল ও মিষ্টি-মিঠাইয়ের নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। মনসা পুজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, গৃহস্থ মহিলারা পৌরোহিত্য করেন এই পুজোয় । পুজোর পর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, অতিথি-অভ্যাগত, প্রতিবেশী ও গরিব দুঃখীদের কলাপাতা পেতে পেটপুরে অরন্ধন পুজার পান্তসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্থাদু ব্যঞ্জন খাইয়ে তৃপ্তি পান গৃহস্থ ভক্তগণ। এই ভোজের জন্য বাড়তি ভাত ও ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হয় ভোগ রান্নার সঙ্গে। রান্না-পুজোর বিভিন্ন ধরণের ভাজা, কুমড়ো-চিংড়ির ঘন্ট, মাছ, চালতার চাটনি, পায়েস, পিঠে, পাকা কলার বড়া ভাজা, পান্তা-ডাল চচ্চড়ি ইলিশ ভাজার প্রতি আকর্ষণ নেই এমন মানুষ দক্ষিণ চবিবশ পরগনায় বিরল। মনসা পুজার ব্যাপকতায় বহু গ্রাম নাম ও স্থান নামের সৃষ্টি হয়েছে জেলায়। মনসাতলা, মনসাবাড়ি, মনসাডাঙা, মনসার বেড়, মনসা দাঁড়ি প্রভৃতি নামে বহু আবাদি খেত-খামার, গ্রাম ও মৌজার সন্ধান মেলে জেলায়। গঙ্গাসাগর দ্বীপের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল মনসাদ্বীপ নামে সুপরিচিত ।

অরন্ধনকে রন্ধন ধর্মঘট বা রান্না বনধও বল। যেতে পারে। বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে কলকারখানা বন্ধ থাকার জন্য এদিনে বাঙলার পুরুষের সাথে সাথে নারী সমাজের ও ছুটি । এই ধরণের কোনদিন ছাড়া অর্থাৎ অরন্ধন ছাড়া অন্য কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের নারী সমাজকে বিশ্রাম বা ছুটি দিতে পারি না । অরন্ধন লোকায়ত অনুষ্ঠান।

ভাদ্র সংক্রান্তির অরন্ধনে যে উনুন পুজা অনুষ্টিত হয় তাঁতে সপ্তপত্রির বদলে মনসা বা সিজ ডালের প্রয়োজন হয় । উনুনের চারদিকে আলপনা দেওয়া হয় । অনেক জায়গায় এই পুজোতেও উনুনের চারপাশে সাতটি মনসা পাতার উপর সাতটি অন্নভোগ দেবার রীতি আছে। পুজান্তে ধনীদরিদ্র নিবিশেষে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবারও প্রথা আছে । এই নিমন্ত্রণে খাওয়ানো হয় পান্তা ভাত ও বাসি তরকারি ।

বঙ্গভঙ্গের ও অরন্ধন

তাই ১৯০৫ সনের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে আশ্বিন সংক্রান্তি (১৬ই অক্টোবর --৩০শে অশ্বিন ) ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গের দিন ঘোষণ] করলেন তখন সারা বাঙলার এ দিনটিকে ক্ষোভ ও দুঃখের প্রতীক করে তোলার আয়োজন কর! হয় । রবীন্দ্রনাথ বঙ্গ মিলনের দাবিতে 'রাখীবন্ধন ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘অরন্ধন' পালন করতে প্রস্তাব আনলেন । রাজনৈতিক সমাজ এ প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করলেন । শোকচিহস্বরূপ আশ্বিন সংক্রান্তি বা ৩০শে আশ্বিন প্রতিপালিত হল অরন্ধন দিবস রূপে। এই অরন্ধনের সঙ্গে ধর্মের অরন্ধনের কোন যোগ ছিল না। এই অরন্ধন ছিল সম্পুর্ণ রাজনৈতিক কারণে । তাই বলা হয়েছিল শিশু ও রোগী ব্যতীত এ দিনে কেউই অন্নজল গ্রহণ করবেন না, সকলেই খালি পায়ে থাকবেন । কোন বাঙালীর ঘরে উনুন ধরবে না। সব বন্ধ। সব ধর্মঘট । এইভাবেই ধর্মাচরণের অঙ্গ অরন্ধন, উপবাস প্রভৃতি কালক্রমে ট্রাডিশন থেকে রাজনৈতিক লড়াই-এর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে । ধর্মীয় উপবাস থেকে এসেছে অনশন ।

প্রতিবাদ এবং শোকে অরন্ধন

তার ও আগে ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে ৫ই আগষ্ট । এদিন নন্দকুমারে ফাঁসির দিন ধার্য হয়। দেশের অনেক গণ্যমান্য লোক, বাঙলার নবাবও ফাঁসির আদেশ রদ করার অনরোধ জানাল । কিন্তু হেস্টিংস কারও কথায় কর্ণপাত করেন নি । নন্দকুমারের ফাঁসির দিন কলকাতার প্রত্যেক হিন্দু পরিবার অরন্ধন পালিত হয়।

লৌকিক সংস্কৃতি কখন বৈদিক সংস্কৃতিতে

অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ধর্মীয় সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত ছিল পরজীবনে বিশ্বাস, পিতৃপুরুষদের পুজা, কৃষি সম্পর্কিত অনেক উৎসব যেমন পৌষপার্বণ, নবান্ন প্রভৃতি, মেয়েদের দ্বারা পালিত অনেক ব্রত এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চালু ছিল । বাংলার আদিম অধিবাসীদের ধর্মই পালন হত মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, মন্ত্রাদি, প্রাকৃতিক শক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, লিঙ্গ পূজা, কুমারী পূজা, ‘(টোটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত, ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূত-প্রেত দ্বারা সংগঠিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন, অনুশাসন ইত্যাদি নিয়ে বাংলার আদিম অধিবাসীদের ধর্ম গঠিত ছিল। এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের অন্তৰ্ভুক্ত হয়ে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়েছিল ।

বস্তুতঃ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনেক কিছু পূজা পার্বণের অনুষ্ঠান যেমন দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষ-পার্বণ, হোলি, ঘেটুপূজা, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁন্দুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় এবং পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও নেওয়া হয়েছিল আটকৌড়ে, শুবচনী পূজা, শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠী পূজা, বিবাহে গাত্র হরিদ্রা, পান খিলি, গুটিখেলা, স্ত্রীআচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মীপূজার সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন, অলক্ষ্মীপূজা ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান যা বর্তমান কালেও বাঙালি হিন্দু পালন করে থাকে । এ সবই প্রাক-আর্য সংস্কৃতির অবদান। এছাড়া নানা রূপ গ্রাম্য দেব-দেবীর পূজা, ধ্বজা পুজা, বৃক্ষের পূজা, বৃষকাষ্ঠ, যাত্রা জাতীয় পর্বাদি যেমন স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, চণ্ডী, মনসা, শীতলা, জাগুলী, পর্ণশবরী, প্রকৃতি পূজা ও অম্বুবাচী, অরন্ধন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক-আর্য জাতিসমূহের কাছ থেকে নেওয়া।

ভারতীয় আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি যে বহু প্রাচীন, তা নির্দিধায় বলা যায়। এই আদিবাসী সংস্কৃতির ভিত্তিমূলের উপর গড়ে উঠেছে আর্য সভ্যতার আধুনিক ইমারত ৷ তাই স্বভাবতই আদিবাসী সংস্কৃতির বহু উপকরণই এই ইমারতের অঙ্গীভূত হয়ে আছে। বাংলার তথা বাঙালির পুজা-পার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, ধর্ম-শিল্পকলা তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন দীর্ঘকাল একে অপরের সাথে সহাবস্থান করার ফলে তাঁদের মধ্যে যেমন ভাবের আদান প্রদান হয়েছে তেমনি সংস্কৃতির আদান প্রদান এবং প্রভাবের ক্ষেত্রটিও অতি সুপ্রাচীন ও সুসম্পর্ক বদ্ধ ৷

বিশ্বকর্মা পূজা সম্পর্কে আরও জানুন: বিশ্বকর্মা পূজার ইতিহাস

এবং বিশ্বকর্মা পুজা

শিল্পবিজ্ঞান-এর নৈপুণ্য বৃদ্ধির জন্য ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মাদেবের পুজার বহুদিন ধরে বাংলা দেশে প্রচলিত আছে। বিশ্বকর্মা পুজার দিন ঘুড়ি ওড়ানো ছিল একটা প্রধান কাজ । আগেকালে ধনী বাঙালী বাবুর দশ টাকার ও একশো টাকার নোট খুড়িতে বেঁধে ঘুড়ি ওড়াতেন। সেই নোট বাধা ঘুড়ি ধরবার জন্য চলতো! ভীষণ প্রতিযোগিতা । এখনও সেই ঘুড়ি ওড়াবার দিন হিসাবে বিশ্বকর্মা পুজার দিনটি ছেলেদের কাছে খুবই প্রিয়্।

আমাদের দেশে ঘুড়ির প্রকারভেদে ভোমরা, ঘয়লা, দ্য-ঘরলা, ঢাউস, চিলে, পতঙ্গ (খুব ছোট ঘুড়ি ), তেলাঈ, বামন, পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গা, বুলুম, ময়ূরপঙ্খী, শতরঞ্চ, চাপরাশ, তারপর পেটকাটি, চাঁদিয়াল, চাপরাশ, ঘয়লা, চৌরঙ্গী, মুখপোড়া, উলটো মুখপোড়া, মাছিয়াল, ঝুমকো, দোভাঁজ, মোমবাতি, ক্রস ইত্যাদি কত নামের ঘুড়ি প্রভৃতি নানা নামাঙ্কিত ঘুড়ি এখনও বিশ্বকর্মা পুজার দিন আকাশে ওড়ে ।

এই শহরেও ময়দানে একসময় আয়োজিত হয়েছে 'ঘুড়ির লিগ'। ঘুড়ি প্রেমীদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল 'ক্যালকাটা কাইট অ্যাসোসিয়েশন'। প্রতিযোগিতা হয়েছে বাংলা, বাইরেও। চিনা মাঞ্জার কারণে ঘুড়ি এখন নিয়ন্ত্রিত। তবু থেমে নেই। বিশ্বকর্মার সঙ্গে একাত্ম হয়েছে ঘুড়ি। দমদম, হাতিবাগানে অতএব জমজমাট ঘুড়িবাজার।


মহাভারতে আছে বিশ্বকর্মা কেবল দেবশিল্পীই নন, ইনি তাঁদের অস্ত্রাদিও নির্মাণ করেন । ইনি শিল্পের শ্রেষ্ঠ কর্তা ; যিনি দেবতাদের 'বিমান-নির্মাতা এবং অলংকার শিল্পী । ইনি সর্বপ্রকার কারুকার্য নির্মাতা এবং কারিগর-শিল্পীদের রক্ষক। তাই যারা শ্রমজীবী এবং বৃত্তিজীবী তাদেরই দেবতা ইনি।

প্রতি বছর ভাদ্রমাসের সংক্লান্তির দিন হাজার হাজার কলকারখানায় খুব ধুমধামের সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজো করে শ্রমজীবী মানুষরা । জমজমাট দিন দুটো যে কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝা যায় না। শ্রমিক-মালিকে ভেদ থাকে না। এই দিনটাতেই এক মাত্র ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কারখানার মালিকরাও নিজেদেরকে শিল্পপতি অনুভব করতে পারে ।

দেবতার বিশেষ মর্যাদা, কারণ গরিব মানুষরা পুজো, নিজেদের অনুষ্ঠান আর নিজেদের নিয়মে চলেন, কারুর দয়া বা অনুগ্রহে, অর্থ সংগ্র হোকে এই পুজো তারা করেন না । ছোট ছোট কারখানা, অপরিসর নোংরা জায়গায় কাজ করতে অভ্যস্ত মানুষ গুলো নিজেদের সামর্থে, ইচ্ছায়, আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটু জায়গায় অল্প আয়োজনে নিষ্ঠা সহকারে পুজোর আয়োজন করেন । কারখানার মধ্যে গাদাগাদি করে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি, নানা মাপের নানা আকারের মেশিন ।

পুজোর আগের দিন বিকেল থেকেই সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সব ঘরেই মেশিনের ঠুকঠাক বন্ধ এই দুই দিন । শ্রমিক কারিগররা তাদের নিজের যন্ত্রপাতিগুলো ঝাড়াপোঁছা করে। তাদের গায়ে ফুলের মালা পরায়। কারখানার দোরগোড়ায় ঘটের মধ্যে নবপত্রিকা রাখা হয়। মালিকরা পটুয়া পাড়ায় গিয়ে পছন্দমত মূর্তি কিনে আনে। যাদের ব্যবসার ঘটা বেশি তাদের ঠাকুরও তত বড়। জাঁকজমক এবং জেল্লা দেখবার মতন। যথেষ্ট দাম দিয়েই তারা প্রতিমা কেনে।

এক রাতের মধ্যেই ঘরে ঘরে আলো জ্বলে । ফুলের মালা আর ধৃপের ধোঁয়ায় ভরে ওঠে অলিগলি । সারা রাত ধরে রান্না হয়, কারণ পরের দিন উনুনেরও ছুটি । পরদিন ভোর থেকেই সবাই মেতে ওঠে উৎসবের খুশীতে । আজ আর মেশিনের শব্দ নেই। ঢাকের বাদ্য শোনা যাচ্ছে , পুরোহিত মশাই প্রতিটা মণ্ডপে আর ঘরে ঘুরে ঘুরে পুজো করছে। এক হাতে অন্য হাতে ঘন্টা । শ্রামকের হাতের সব যন্ত্রই যেন দেবতার আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হচ্ছে।

বিশ্বকর্মা পুজোকে আমরা ছোটবেলা থেকে বলে এসেছি 'রিকশা পুজো' । কারণ কলকাতার সাধারণ মানুষের সরাসরি রোজকার সম্পর্ক এদের সাথে। অন্য কলকারখানায় যেমন সমারোহ করে পুজা-উৎসব হয়, রিক্সামালিক এবং চালকদের পুজোতেও তেমনই ধুমধাম আর আড়ম্বর হয়। পূজোর আগের দিন সব রিকশাওলারাই যত্ন করে গাড়ি ঝাড়াপোঁছা করে। গাড়ির গায়ের আঁচড়ের দাগগুলো রঙ দিয়ে ঢেকে, চাকার গর্তে খানিকটা সরষের তেলের ফোঁটা ফেলে দেয়, যাতে অবাঞ্চিত ঘড়ঘড় শব্দে দেবতা ও সওয়ারী বিরক্ত না হন। দুই দিন পুরো বিশ্রাম গাড়ি দেবতার ।

Reference:

১. দুর্গাচরণ সান্যাল. বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস (প্রথম সংস্করণ). কলকাতা : মডেল পাবলিশিং হাউস, ১৯০৮, পৃ ২

২. ডঃ অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন (চতুর্থ সংস্করণ). কলকাতা : সাহিত্যলোক, ২০১২, পৃ. ২১

৩. পরিমল হেমব্ৰম. সাঁওতালি ভাষা-চর্চা ও বিকাশের ইতিবৃত্ত (প্রথম সংস্করণ). কলকাতা : নির্মল বুক এজেলী, ২০১০, পৃ. ৩৪

৪. Edible Medicinal and Non Medicinal Plants: Volume 9, Modified Stems, Roots ... By T. K. Lim